চারপাশে লবণ পানির মৎস্য ঘের। এরই মাঝে রাবেয়া সুলতানার বসতবাড়িতে শোভা পাচ্ছে লাউ, পুঁইশাক, ধুন্দল, করলা, কুমড়া, শসা, ঢেঁড়স, বরবটি, লালশাক, টমেটো, মরিচ, বেগুন, পেঁপেসহ নানা ধরনের সবজি। এছাড়াও রয়েছে থানকুনি ও অন্যান্য ওষধি গাছ। শুধু নিজের পরিবারের জন্যই এসব উৎপাদন নয়, প্রতিবেশিদেরও নিয়মিত সবজি সরবরাহ করেন তিনি। তার বাড়ি থেকেই এখন গ্রামের মানুষ সবজি কিনে নিয়ে যায়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের রাবেয়া সুলতানার এই পুষ্টি ও জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ কৃষি খামার স্থানীয়ভাবে পরিবারভিত্তিক পুষ্টিব্যাংক ‘শত বাড়ি উন্নয়ন মডেল’ নামে পরিচিত।
শতবাড়ি মডেলকে ঘিরে রাবেয়া সুলতানার নেতৃত্বে পদ্মপুকুরে গড়ে উঠেছে একটি নারী সংগঠন। এই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে প্রতি মাসে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা, প্রশিক্ষণ ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
এসব কর্মসূচির মাধ্যমে স্থানীয় নারীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়, বীজ ও কৃষি জ্ঞান বিনিময় করে এবং যৌথভাবে সঞ্চয় কর্মসূচিও চালায়। এই সংগঠনের মাধ্যমে নারীরা পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জৈব কৃষির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। এটি কেবল একটি পুষ্টি চর্চাকেন্দ্র নয়, বরং নারীর সামাজিক শক্তি বৃদ্ধিকরণ ও নেতৃত্ব বিকাশের একটি বড় উদাহরণ।
রাবেয়ার এই শতবাড়ি মডেল এখন একটি কমিউনিটি শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তার এই উদ্যোগ কেবল তার পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে না, বরং তা হয়ে উঠেছে একটি প্রাণবৈচিত্র সংরক্ষণ ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রাণকেন্দ্র।
জানা গেছে, করোনো মহামারি চলাকালীন যখন সারাদেশেই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়, তখন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক তাকে নিজ বাড়িতেই নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে ‘পুষ্টি ব্যাংক’ গড়ে তোলার পরামর্শ দেয়। এরপর পেরিয়েছে প্রায় অর্ধযুগ। রাবেয়া সুলতানার বাড়ি এখন পুষ্টি উপকরণ ও জীববৈচিত্রে ভরপুর।
রাবেয়া সুলতানা জানান, তিনি মৌসুম অনুযায়ী স্থানীয় বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন এবং তা নিয়মিত অন্যদের মাঝেও বিতরণ করেন। এতে কম খরচে উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে এবং স্থানীয় জাত সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ হচ্ছে।
তিনি বলেন, “প্রতিবছর আমি ৭-৮ ধরনের মৌসুমি বীজ সংরক্ষণ করি। কেউ বীজ চাইলে আমি দেই, আবার অন্যদের থেকেও আদান-প্রদান করি। আমি স্থানীয় জাতের বীজ ব্যাংক তৈরির চেষ্টা করছি।”
টেকসই কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য রাবেয়া সুলতানার এই উদ্যোগ নিয়ে গবেষক মফিজুর রহমান বলেন, উপকূলীয় দুর্যোগকবলিত ও লবণাক্ত এলাকায় শতবাড়ি উন্নয়ন মডেল একটি আত্মনির্ভর পদ্ধতি। যা স্থানীয়দের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সক্ষম করে তুলছে এবং নারীর ক্ষমতায়নের মডেল হিসেবে প্রশংসাযোগ্য। তার এই ‘শতবাড়ি’ এখন কেবল একটি কৃষি উদ্যোগ নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক আন্দোলন, যেখানে নারীর হাত ধরে গড়ে উঠছে একটি পুষ্টিকর, পরিবেশবান্ধব ও স্বনির্ভর গ্রামীণ সমাজ।
খুুলনা গেজেট/এনএম